হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক যখন দেশ এবং রাজ্যে প্রায় ভাঙনের মুখে, একি সাথে এই ধরণের সম্প্রীতির ঘটনাও সামনে আসছে পরপর। মাতলা ১ গ্রামপঞ্চায়েতের ঘোষপাড়া দিনভর সরগরম ছিল সম্প্রীতির এমন দৃষ্টান্তে। স্থানীয় সূত্রের খবর, মালদহের কালিয়াচক থানার ১৬ মাইল গুরুতলার বাসিন্দা রুমা খাতুন। বছর বাইশের গৃহবধুর বিয়ে হয়েছিল দুই বছর আগে কালিয়াচক থানার শেরসাহির আনোয়ার সেখের সঙ্গে। স্বামী আনোয়ার দীনমজুরের কাজে বাইরেই থাকেন বেশিরভাগ সময়।
এদিকে শ্বশুরবাড়িতে শ্বশুর ও শাশুড়ির অত্যাচারে জর্জরিত হতে থাকে রুমা।
গত ১১ সেপ্টেম্বর সেই ক্ষোভে ঘর ছাড়েন ওই বধূ। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসেন। আবার সেই দিনই কোন এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বাপের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন রুমা।
করোনা পরিস্থিতিতে রাজ্যজুড়ে লকডাউন থাকায় রাস্তায় বেরিয়ে কী করবেন ভেবে উঠতে পারছিলেন না ওই বধূ। তাই ফুটপাথে রাত কাটিয়ে ১২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা নাগাদ সড়কপথে ট্রেকারে করে ক্যানিং ষ্টেশনে পৌছান। সন্ধ্যা থেকে রাত আট টা অব্ধি স্টেশন সংলগ্ন বাজারের কাছে উদভ্রান্ত হয়ে ঘোরাঘুরির সময় নজরে পড়েন ওই বাজারেরই মাছ বিক্রেতা গৃহবধু বাসন্তী মণ্ডলের। । ওই বধূকে কাছে ডেকে জানতে চাইলে তখন সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন মালদহের ওই বধূ এবং বাড়ি ফেরার জন্য কান্নাকাটি শুরু করেন। এরপর সমস্ত দিক ভেবেচিন্তে মুসলিম পরিবারের ওই বধূকে বাসন্তীদেবী তাঁর ঘোষপাড়ার বাড়িতে নিয়ে যান। নিজের মেয়ের মতোই তাকে দেখাশোনা করেন ও আগলে রাখেন শুক্রবার রাত থেকে। পাশাপাশি বাসন্তীদেবী তাঁকে তাঁর নিজের বাড়ি ফেরানোর জন্য উদ্যোগও নেন। ফোন নম্বর নিয়ে রুমার বাবা সাবিরুদ্দিন সেখের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন। নিখোঁজ মেয়ের খোঁজ পেয়ে তিনি মালদহ থেকে সেদিন রাতেই তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়েন সড়কপথে । বুধবার বেলা বারোটা নাগাদ ক্যানিং ষ্টেশন এলাকায় সাবিরুদ্দিন সেখ পৌঁছালে স্থানীয় যুবক সিকান্দর সাহানী, তারক দাস, বাপন মন্ডল, নাসিরউদ্দিন লস্করদের সাহায্যে ক্যানিংয়ের ঘোষপাড়ায় বাসন্তী দেবীর বাড়িতে পৌঁছান। সাবিরুদ্দিন বাবু কে আদর আপ্যায়ন করে মধ্যাহ্ন ভোজেরও ব্যবস্থা করেন বাসন্তীদেবী। তারপর বাপের হাতে তাঁর হারিয়ে যাওয়া মেয়ে রুমাকে তুলে দেন। বাসন্তীদেবী বললেন “রুমাকে উদ্ধার করে ঘরে নিয়ে এসেছিলাম রাতের অন্ধকারে। আমার মেয়ের মতোই ছিলও পাঁচটা দিন ধরে। আমাকে মা বলেই ডাকতো। আজ অক্ষত অবস্থায় তার পরিবারের হাতে তাকে তুলে দিতে পেরে একজন মহিলা হিসাবে ভালো লাগছে। তবে ও চলে যাওয়ায় খুব খারাপও লাগছে। কে হিন্দু, কে মুসলমান জানি না। এটুকু জানি ও আমায় মা বলে ডেকেছে।”
মেয়েকে ফিরে পেয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারছিলেন না রুমার বাবা। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিলো বারববার। তিনি বলেন, ”মেয়ে কে যে অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাব ভাবিনি। বাসন্তীদেবী আজ থেকে আমাদের পরিবারের একজন সদস্য হলেন। তাঁর এই অবদান কোনও দিনও ভুলব না।” বিদায় নেওয়ার সময় দু’চোখের জল বাঁধ মানছিল না রুমার।এবারে আর হারিয়ে গিয়ে নয়, এবার ক্যানিংয়ে মায়ের বাড়িতে বেড়াতে আসবে বলে জানিয়ে যায় সে।এই ঘটনায় একটা গানের কথা মাথায় আসে। ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে,
“মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন তো জীবনেরই জন্যে, একটু সহানুভুতি কি মানুষ পেতে পারেনা!”
প্রতিবেদনে-জাহেদ আলী